তোত্তো-চান : 'তোমোই গাকুয়েন' - একটি প্রকৃত বিদ্যালয় - শতাব্দী


মৌসুমী ভৌমিকের অবদান

"নতুন স্কুলের গেটখানা দেখা-মাত্র তোত্তো-চান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আগের স্কুলের গেটে,ভারি সিমেন্টের থামের উপরে স্কুলের নামটা বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিলো। তোত্তো-চান দেখলো যে এই স্কুলের গেটটা অনেক নিচু,আর তার ওপর অনেক ডালপালা,লতাপাতা এসে পড়েছে।

হাওয়ায় স্কুলের নাম লেখা বোর্ডটা একটু সরে গিয়েছিলো। তাই কাছাকাছি পৌঁছনোর পর তোত্তো-চানকে বেশ ঘাড় কাত করে নামটা পড়তে হলো। 'তো-মো-ই গা-কু-য়ে-ন। 'ও কি স্বপ্ন দেখছে? 'মা, ওটা কি একটা সত্যিকারের রেলগাড়ি? ওই যে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে?' সকালের সূর্যের আলোতে রেলগাড়ির জানালাগুলো চকচক করছিলো। কিন্তু ছোট্ট যে মেয়েটা ওই গাড়ির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলো,তার মুখটা যেন ঐ জানালার চেয়েও বেশি চকচক করছিলো।"


বাতিল রেলগাড়ির কামরাগুলি এক একটি ক্লাস রুম। শুনেই বিস্ময় জাগে,ঠিক তোত্তো-চানের মতোই। যেন এ এক স্বপ্নলোকে বিচরণ,কল্প জগতের ইস্কুল-বাড়ি।তাই হেড-মাস্টার মশাই তোত্তো-চানের মতো ছোট্ট মেয়ের কাছে হয়ে যান স্টেশন-মাস্টার।গাছপালা ঘেরা,খোলা মাঠ,লতাপাতা জড়ানো স্কুলের গেট,গাছে গাছে ফুলে ফুলে ভরা চারপাশ।অফিস-বাড়ির মতো স্কুলগুলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ।
বিদ্যালয়ের চেহারা হয়তো এমনই ছিল
ইস্কুলের সবচেয়ে মজাদার কথা হল 'সাগর থেকে পাহাড় থেকে'।টিফিনের সময় সকল ছাত্র-ছাত্রীদের টিফিন বক্সে এই সাগর থেকে পাহাড় থেকে কিছু কিছু থাকতেই হত।না থাকলে ইস্কুলের স্টেশন-মাস্টার নিজের ঘর থেকেই সেই ছাত্রের বক্সে অনুপস্থিত খাবারটি ভরে দিতেন।প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার প্রতিটি শিশুকে নিয়মিত দিতে হবে।তাই সাগর থেকে অর্থাৎ সামুদ্রিক খাবার - মাছ,কাঁকড়া,চিংড়ি।আর পাহাড় থেকে মানে শাক-সব্জি,মাংস এইসব।

আরো কতরকমের আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটত তোমোই তে। গতানুগতিক ধারায় নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট পিরিয়ডে নির্দিষ্ট বিষয় পাঠের ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে যার যখন খুশি,যেমন খুশি বিষয় পড়ার স্বাধীনতা ছিল।এইভাবে পড়ানোর উদ্দেশ্য হল - কার কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ তা অনুধাবন করতে পারা।ফলত ছাত্র-ছাত্রীদের মনের আয়নায় তাদেরকে উপলব্ধি করা অনেক সহজসাধ্য হবে। অতি আধুনিক বিদ্যালয়গুলির মতো কোনো স্পেশাল স্কুল নয়,শারীরিক ভাবে অসমর্থ এবং সক্ষম উভয়েই একই সাথে পাশাপাশি চলত তোমোই তে। ভালো করে চিবিয়ে খাওয়া,খাওয়ার পর হাঁটতে যাওয়া,প্রকৃতির সংস্পর্শে থেকে প্রকৃত শিক্ষালাভ একমাত্র তোমোই-তেই সম্ভব ছিল।

 হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া কাকে বলে তা তোত্তো-চানদের কৃষিকাজের মাস্টার-মশাইয়ের সাথে পরিচিত হলেই বোঝা যায়। 'আমি তো শুধু ক্ষেতে কাজ করি' - এরকম সমাজবন্ধুকে ইস্কুলের মাস্টার বলতে পারেন একমাত্র সোসাকু কোবায়াশি,তোমোই-এর হেড মাস্টার মশাই । তোমোই-তে একবার এলে কেউ বঞ্চিত হত না,খালি হাতে কাউকেই ফিরে যেতে হত না। তাই যখন বাইরে আমেরিকা জাপানের চরম বিরোধী ,তখন তোত্তো-চান ও তার বন্ধুরা আমেরিকান মিয়াজাকিকে আপন করে নিয়েছিল।এবং হেড মাস্টার মশাইয়ের নির্দেশ মেনে একে অপরকে নিজ নিজ মাতৃভাষা শেখানো শুরু করেছিল। আর সবচেয়ে বেশি মন ছুঁয়ে যায় যখন প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তিন তারিখ নিয়ম করে ওদের পুনর্মিলন উৎসব হয়।

1945 সালে টোকিওর ওপর যখন ক্রমাগত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল,তখন বি 29 বোমারু বিমান থেকে গোলা
১৯৪৫ এর সেই সময়
এসে পড়ে রেলগাড়ি স্কুল বাড়িটাকে গ্রাস করে নিয়েছিল কিন্তু সোসাকু কোবায়াশির মনে স্কুলের প্রতি আর শিশুদের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা ছিল তাকে কোনো আগুন কোনোদিনও পোড়াতে পারেনি। টোকিও শহরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে, জিয়ুগায়োকা স্টেশন থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে তোমোই গাকুয়েন স্কুল। মিস্টার কোবায়াশির শিক্ষাচিন্তার প্রতিফলন স্বরূপ এই স্কুল। যেখানে শিশু মনের সারল্য,সৌন্দর্য প্রকৃত রূপে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেত। তাদের সহজাত গুণের ভান্ডারই যাতে তাদের পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করতে পারে,তারই বাস্তব নিদর্শন তোমোই।

Tetsuko Kuroyanagi
মূল জাপানিজ ভাষার বইটির লেখক



মিস্টার কোবায়াশি দীর্ঘদিন পড়াশুনা করে,নিজেকে প্রস্তুত করে 1937 সালে তোমোই প্রতিষ্ঠা করেন। আর 1945 এর মধ্যে তার শরীরপাতন ঘটে। কিন্তু যে শিক্ষা তোমোই আজও দেয়,তা হয়তো খুব কম মানুষই বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন দেখে।

Comments

Popular posts from this blog

সুডুকু মেলানোর উপায়- নীলেশ

খিস্তি সুখের উল্লাসে- নীলাদ্রি