'অন্ধের স্পর্শের মতো' : এক অনুচ্চকিত অনুভবের উপাখ্যান -নীলাদ্রি
সেদিন দূরপাল্লার বাসে করে ফিরছি। সিট পেয়েছি একদম সামনে। কিছুক্ষণ পর থেকেই হর্ণের তীব্র আওয়াজে কান ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করলো। বাড়ি ফেরার পর দু'তিন দিন লেগেছিল কানের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে! মনে আছে কলেজ ফেস্টে স্টেজ জোড়া সাউন্ড বক্সের প্রবল নিনাদের মধ্যে কাটিয়ে এসেও একই অবস্থা হতো। তবে এসব তো গেল শরীরের কানের কথা! আর মনের কান? মনের যে কানটি আমাদের তৈরি করে নিতে হয় অল্পে অল্পে, সেটা কি সবসময় সুস্থ থাকে? সুস্থ থাকতে আদৌ পারে?
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক পেরিয়ে ক্রমশ এক উন্মাদ আধুনিকতার দিকে ছুটছি বলে মনে হয়! যত দিন যাচ্ছে, আমরা যেন ততই কেমন লাউড আর স্থূল হয়ে যাচ্ছি! সর্বত্র শুধু 'আমি'-র ছড়াছড়ি! চিৎকার করে ছাড়া কেউ কথাই বলতে পারছি না! আর সত্যি বলতে কী, চিৎকার না করলে কারো কানে কথা পৌঁছে দেওয়াও যাচ্ছে না! চাদ্দিকে এই কোলাহলের মধ্যে পড়ে যখন ভেতর থেকে হাঁপিয়ে উঠছি, ঠিক তখনই সামনে দেখি এক আশ্চর্য জাদুর তোরণ! যার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছন্দে পৌঁছে যাওয়া গেল এক শান্তির উপত্যকায়!
বইটির নাম 'অন্ধের স্পর্শের মতো'। প্রণবেশ সেন স্মারক সভায় কবি শঙ্খ ঘোষের বক্তৃতার সংকলন এই বই। পড়তে পড়তে খালি মনে হচ্ছিল, ঠিক এই কথাগুলো ঠিক এই সময়ে শোনবার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে ভীষণই উন্মুখ ছিলাম! আত্মপ্রচারসর্বস্ব এই যে আমরা সবখানে নিজস্ব ঢাক বহন করে নিয়ে চলেছি, আর সুযোগ পেলেই দমাদ্দম বাজিয়ে আশপাশের মানুষগুলোর কান, মন ঝালাপালা করে দিচ্ছি, এই সার্কাসে একটু নীরবতার ভাষা শোনার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলাম বহুদিন। প্রবল চিৎকারের মধ্যে একটা অবধারিত ক্লান্তি থাকে। ওই যে কলেজে ডিজে বা ব্যান্ডের তালে দুদিন চূড়ান্ত নাচানাচির পর এক প্রগাঢ় বিষন্নতা গ্রাস করতো, ঠিক সেরকম দীর্ঘস্থায়ী কোলাহলের মাঝে থেকেও, মধ্যে মধ্যে একইরকম অবসন্ন লাগে। সব মিথ্যে মনে হয়। অজস্র বুদবুদের মানুষকে চারপাশে হাঁটাহাঁটি, মারামারি করতে দেখে আজকাল বিরক্তির চেয়েও ভয় হয় বেশি। পাশাপাশি একা লাগে খুব!
এই যে এতক্ষণ বর্তমান বিশ্বে মানব জাতির অধঃপতন নিয়ে এত কথার চাষ করলাম, এর মধ্যেও কি আগাগোড়া 'আমি' ঢুকে নেই? শুরুতেই তো স্পষ্ট করে দিয়েছি নিজের অবস্থান। বুঝিয়ে দেওয়া গেছে যে আমি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। বুঝিয়ে দিয়েছি, আমি স্রোতে গা ভাসানো এই ভিড় থেকে নিজেকে সরিয়ে ব্যতিক্রমী করে রেখেছি! আর এই সূত্রেই যেন পেয়ে গেছি সবার সমালোচনা করার সুযোগ! এই প্রবণতাটাই সবচেয়ে ভয়ের। চিৎকার করে চিৎকারের প্রতিরোধ করা যায় না। বা গেলেও সেটা সুদূরপ্রসারী উপায় হতে পারে না। সন্দীপরা যখন উত্তেজনায় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড দখল করতে উদ্যত হয়, তখন নিখিলেশদের কিন্তু শান্ত হাতেই সব পরিস্থিতি সামলাতে হয়। নিখিলেশের স্রষ্টা তাঁর 'শান্তিনিকেতন ভাষণমালা'-র এক জায়গায় বলেছেন-
"আমরা সমস্ত দিন কতরকম করে যে শক্তির অপব্যয় করে চলি তার ঠিকানা নেই- কত বাজে কথায়, কত বাজে কাজে। নিষ্ঠা হঠাৎ স্মরণ করিয়ে দেয়, এই যে-জিনিসটা এমন করে ফেলাছড়া করছ এটার যে খুব প্রয়োজন আছে। একটু চুপ করো, একটু স্থির হও, অত বাড়িয়ে ব'লো না, অমন মাত্রা ছাড়িয়ে চ'লো না।"
কথাগুলো পড়লে মনে হয়, এই চিল-চিৎকারের পৃথিবীর বিপ্রতীপে এখনো কয়েকজন মানুষ তো আছেন যারা ছাতিম গাছের তলায় বসে নীরবতার সাধনা করে চলেছেন একাগ্র চিত্তে...
এমনিতেই নিখিলেশ চরিত্রটা অসম্ভব ফ্যাসিনেট করে আমাকে। ভালো লাগে শোভনলাল বা ভূপতির মতো মানুষদের। কিন্তু আশেপাশে সন্দীপ বা অমিতদের ভিড়ে যখন দমবন্ধ লাগে, অথবা নিজেও যখন তাদেরই মতো বাচাল আর উচ্চকিত হয়ে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাই, তখনই রবি ঠাকুর বা শঙ্খ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বরা বন্ধু হয়ে পাশে এসে বসেন। ভরসার হাত রাখেন আমার ঝুলে পড়া কাঁধে।
এইসব লেখা কোথায় গিয়ে যেন নতুন করে ভাবতে বাধ্য করায়! এমন তো নয় যে এসব আমাদের মনে, মাথায় থাকে না। তা সত্ত্বেও একই কথা যখন রবি ঠাকুর বলেন, তখন বেশি উদ্বেলিত হই কেন?
'জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা' সিনেমায় একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে। অভয় দেওল অভিনিত কবীর চরিত্রটি নিজে বুঝতে পারছে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছে, তবু সে তার প্রিয় দুই বন্ধুর থেকে শুনতে চেয়েছিল এই বিষয়ে। মাঝে মাঝে এই বাইরের আওয়াজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর সেটা শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মানুষদের জন্যই না, সকলের জন্য দরকার।
শঙ্খ বাবুর এই বক্তৃতায় মূল বক্তব্য বিষয় ছিল 'সংযোগের ভাষা'! এই সংযোগ সবসময় মৌখিক হতে হবে তার কোনো মানে নেই। শরীরী ভাষাতেও তো সংযোগ স্থাপন করা যায়! সেই নীরব সংযোগ, যা অনেকটাই আত্মিক, সেটাই আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত! সেটা হারিয়ে যাচ্ছে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতাতেও যেমন, তেমনি বোঝার অপারগতার জন্যও! আচ্ছা, আমরা কি দিনদিন অনুভূতিহীন যন্ত্রে পরিণত হচ্ছি?
ট্রেনে বাসে চলতে চলতে ইদানীং যেটা প্রায়ই চোখে পড়ে, তা হলো- যখন তখন সামান্য কোনো কারণেই মানুষজন ক্ষিপ্ত হয়ে যান! চারিদিকে শাসক দলগুলোর অসহিষ্ণুতা নিয়ে ভুরি ভুরি নিউজপ্রিন্ট রোজ খরচা হয়; কিন্তু আমরা যারা সাধারণ দশটা পাঁচটার মানুষ, আমাদের মধ্যেও কি পর্যাপ্ত ধৈর্য রয়েছে? এই উদ্ধত জনতা নিছক একটা বসবার সিটের জন্যও অনায়াসে হাতাহাতি করতে পারেন! এহেন মানুষদের কাছে মৃদুতা, সংযম বা সহিষ্ণুতা কীভাবে আশা করবো! কেই বা তাদের বোঝাবে যে রাস্তা ঘাটে বাওয়াল করাটা কখনোই যথার্থ বীর্যের পরিচয় নয়!
অন্ধের স্পর্শের মতো বইটিতে 'আমি' আর 'আমরা'-র কয়েকটি চমৎকার সমীকরণ আছে। লেখক দেখিয়েছেন আজকাল 'আমরা'-গুলো কী সহজেই 'আমি' হয়ে যায় আমাদের ভাষ্যে। সবকিছু ছাপিয়ে এই আমিত্ব-টাই হয়ে ওঠে প্রধান। তবে এর বাইরেও থাকেন এমন কয়েকজন মানুষ, যারা আমিকে উল্টে বদলে ফেলেন আমরা-তে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন-
"অনেকদিন আগে একজন চিকিৎসক এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে, রোগী দেখবার জন্য। প্রাথমিক পরীক্ষা করে নেবার পর যখন তিনি বিধান লিখতে যাবেন, তখন বললেন আমাকে: 'এই ওষুধটা দিয়ে দুদিন আমরা দেখব। এতে যদি ফল না হয় তাহলে আমাদের আরেকরকম করে ভাবতে হবে।' তাঁর কথা শুনে অবাক হচ্ছিলাম। চিকিৎসা তো করবেন উনি, তাহলে 'আমরা দেখব' 'আমাদের ভাবতে হবে' এভাবে কেন বলছেন? বলার তো কথা 'আমি দেখব' 'আমাকে অন্যরকম ভাবতে হবে'? সেটাই তো হতো সত্য কথা? সত্যি হতো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও ঠিক যে ওই একটিমাত্র সত্যিকে মিথ্যে করে দিয়ে, ওই একটিমাত্র শব্দবদলে, 'আমি'র থেকে 'আমরা'য় পৌঁছে দিয়ে, ডাক্তারবাবু তাঁর রোগীটির সঙ্গে সঙ্গে রোগীর পরিজনদের অনেকখানি শুশ্রূষা করে নিলেন।"
ঘটনাটি পড়ে মনে হল, এইসব মানুষেরা এখনো আছেন বলেই পৃথিবীটা এখনো পুরোপুরি ফেসবুকের দেওয়ালে পরিণত হয়নি।
একটু অন্যরকম অ্যাপ্রোচ থেকে হলেও প্রায় একইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমারও। তখন বি.এড করছি। ফাইনালের আগে লেসন প্ল্যান, চার্ট, মডেল এসব নিয়ে তথৈবচ অবস্থা! সেই সময় আমার এক বন্ধু বি.এডের জন্য একটা মডেল বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। সে তার নিজস্ব কাজের ব্যস্ততার মাঝেও যখন মডেলটি বানাচ্ছিল তখন বি.এড কোর্সের নানান কাজের চাপে আমি খুবই উদ্বিগ্ন থাকতাম। একদিন বন্ধুটি আমার মডেলের জন্য থার্মোকল কাটতে কাটতে বলেছিল, "চাপ নিস না ভাই; আমরা ঠিক পাশ করে যাবো!" ও তো বি.এড করছিল না, তবু ওর মুখে এই 'আমরা' শব্দটাই যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল! বুঝেছিলাম, আমি একা নই! পাশে আরো নিজস্ব কিছু 'জন' আছে।
মাত্র ৪৫ পাতার এই ছোট্ট বইটি থেকে প্রতিটা লাইন, প্রতিটা শব্দ উদ্ধৃত করতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু তার চেয়ে 'গাঙচিল' থেকে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলাই বেশি কার্যকর হবে। তবে বইটির শেষ প্যারাটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করা গেল না। শঙ্খ বাবুর বক্তৃতার শেষ কয়েক মিনিট তুলে ধরেই লেখাটি শেষ করছি। তিনি লিখেছেন-
"মাসদেড়েক আগে, বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের প্রযোজনায়, একটি অভিনয় চলছিল কার্জন পার্কে। পড়তি বিকেলে, খোলা জায়গায়, ছোট একটি বৃত্ত তৈরি করে নিয়ে সেখানে রক্তকরবীর অভিনয় করছিলেন কয়েকজন মানুষ, কেউ যাঁরা চোখে দেখতে পান না। দর্শক ছিলেন অল্প কয়েকজন। পূর্ণ অন্ধদের সেই সুঠাম অভিনয়শেষে দর্শকেরা যখন উচ্ছ্বাস জানাচ্ছেন, আশ্চর্য একটি দৃশ্যের জন্ম হল তখন। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে কুশীলবেরা সবাই তাঁদের খোলা দুহাত বাড়িয়ে রেখেছেন প্রার্থীর মতো। কী চান তাঁরা? কিছু কি চান? তাঁদের মধ্যে একজন বললেন: 'আপনারা সবাই এসেছেন, কিন্তু আমরা তো দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা যদি আমাদের সকলের হাতের ওপর একটু হাত ছুঁয়ে যান, আপনাদের ভালো-লাগাটা আমাদের মধ্যে পৌঁছবে, আমাদের ভালো লাগবে।' দর্শকেরা একে একে সকলের হাতে হাত রাখলেন, কারো কারো চোখে এল জল।
আমরা যখন সত্যিকারের সংযোগ চাই, আমরা যখন কথা বলি, আমরা ঠিক এমনই কিছু শব্দ খুঁজে নিতে চাই, এমনই কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছয়। পারি না হয়তো, কিন্তু খুঁজতে তবু হয়, সবসময়েই খুঁজে যেতে হয় শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।"
বইটির ভালো লাগার জায়গাগুলো মনে হয় কিঞ্চিৎ উঁচু উঁচু হয়ে থাকে। তাই চোখবুজে আলতো ছুঁলেও একই ভাবে অনেকেরই একই বিষয় ভালোলাগার সুখানুভূতি দেয়।
ReplyDeleteএকই বিষয়গুলো মনে ভেসে আসে আমারও বইয়ের মলাটটি দেখলেই।